মিরাজ | معراج | মিরাজ এর সংক্ষিপ্ত ঘটনা

 
মিরাজ এর সংক্ষিপ্ত ঘটনা

মিরাজ এর সংক্ষিপ্ত ঘটনা

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনে মিরাজ এক অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর ঘটনা। এটি রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়াতের উজ্জ্বল নির্দশন, এক জীবন্ত মুযিজা। কুরাইশদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রাসূলকে সান্ত্বনাদানের নিমিত্তে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর হাবিবের সাথে সাক্ষাতের জন্য এ মহাপরিভ্রমণের আয়োজন করেন।মিরাজ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি; যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন। সূরা বনী ইসরাঈল: ১

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মিরাজের ঘটনা: বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মিরাজ এক বিস্ময়কর ঘটনা। মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূলকে সৃষ্টি জগতের রহস্য অবলোকন করান এবং তাঁর উম্মতের জন্য কতিপয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

১. মিরাজের সময় ও তারিখ: নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সিরাত ও ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনা মতে, মহানবি (সা.) এর নবুওয়াতের দশম বছরে হিজরতের অল্প কিছুদিন পূর্বে ৬২০ খ্রি. মতান্তরে ৬২১ খ্রিস্টাব্দে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৭ তারিখ গভীর রজনীতে মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়।

২. ঐ রাতে রাসূলের অবস্থান: মিরাজ সংঘটিত হওয়ার রাতে রাসূল (সা.) তাঁর চাচাত বোন উম্মে হানীর ঘরে অথবা কাবা শরীফের চত্বরে শায়িত ছিলেন।

৩. ফেরেশতার আগমন: মিরাজের রাতে রাসূল (সা.) যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন হযরত জীবরাইল (আ.) এর নেতৃত্বে তিনজন ফেরেশতার আগমণ ঘটে। তারা হলেন, হযরত জীবরাইল (আ.), হযরত মীকাঈল (আ.) ও হযরত ইসরাফীল (আ.)।

৪. রাসূল (সা.) এর বক্ষ বিদারণ: ফেরেশতাগণ রাসূল (সা.) কে জাগিয়ে কাবার চত্বরে যমযম কূপের কাছে নিয়ে আসেন। যেখানে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং হৃৎপিণ্ড বের করে স্বর্গের তশতরীতে রেখে যমযম কূপের পানি দ্বারা ধৌত করে দেন। তাতে ঈমান, ইলম, ধৈর্য ও হিকমত দ্বারা পূর্ণ করে দেন। ফলে এটি পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে যায়।

৫. যাত্রা শুরু: হযরত জীবরাইল (আ.) মিরাজের সফরের জন্য জান্নাত থেকে ‘বুরাক’ নামক বৈদ্যুতিক বাহন নিয়ে এসেছিলেন। বক্ষ বিদারণের পর রাসূল (সা.) কে বুরাকের পিঠে চড়িয়ে হযরত জীবরাইল (আ.) ও অপর দুজন ফেরেশতা যাত্রা শুরু করেন। বুরাক চোখের পলকে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলেন।

৬. বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস: বায়তুল্লাহ থেকে রওয়ানা হয়ে জীবরাইল (আ.) রাসূল (সা.) কে নিয়ে প্রথমে মদিনা মুনাওয়ারা তারপর সিনাই পর্বত, এরপর হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মস্থান ‘বাইতে লাহম’ হয়ে জেরুজালেমে আল-আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছান।

৭. সালাতে রাসূল (সা.) এর ইমামতি: মহান আল্লাহ ইচ্ছায় বায়তুল মুকাদ্দাসে আগে থেকেই পূর্বের সমস্ত নবি-রাসূল সমবেত হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) বায়তুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত হয়ে তিনি ইমাম হয়ে সমস্ত নবি-রাসূলকে নিয়ে দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করেন। এভাবে আল্লাহ তাঁকে সমস্ত নবিদের ইমাম বানিয়ে দেন। ফলে রাসূল (সা.) ইমামুল মুরসালীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। সালাত শেষে রাসূল (সা.) তাঁকে সমস্ত নবিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

৮. ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা: বায়তুল মুকাদ্দাসে সালাত ও সাক্ষাৎপর্ব শেষে জীবরাইল (আ.) রাসূল (সা.) কে নিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা শুরু করেন। রাসূল (সা.) আকাশের দরজার কাছে পৌঁছালে দ্বাররক্ষী মুহাম্মদ (সা.) কে অভিনন্দন জানান এবং তাঁকে দরূদ ও সালাম পেশ করেন।

৯. বিভিন্ন আকাশে নবিদের সাথে সাক্ষাৎ: ঊর্ধ্বাকাশে পৌঁছে রাসূল (সা.) বিভিন্ন নবিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এর সাথে সাক্ষাত লাভ করেন। রাসূল (সা.) প্রত্যেকেই সালাম দেন এবং সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানায়।

১০. সীদরাতুল মুন্তাহায় উপনীত: সপ্তম আকাশে জান্নাত জাহান্নামসহ বিভিন্ন নিদর্শন অবলোকন শেষে রাসূল (সা.) হযরত জীবরাইল (আ.) এর সাথে ‘সিদরাতুল মুন্তাহায়’ উপনীত হন। এখানে অবস্থিত ‘বায়তুল মামুর’ মসজিদে তিনি সালাত আদায় করেন। সিদরাতুল মুন্তাহাই হচ্ছে জীবরাইল (আ.) এর শেষ সীমা।

১১. আরো ঊর্ধ্বে গমন: মহান আল্লাহর দিদার লাভ করতে হলে রাসূল (সা.) কে সিদরাতুল মুন্তাহা পেরিয়ে আরো অনেক ঊর্ধ্বে যেতে হবে। কিন্তু সিদরাতুল মুন্তাহা জীবরাইল (আ.) এর শেষ সীমা হওয়ায় রাসূল (সা.) কে একাই যেতে হবে। এসময় রাসূল (সা.) এর সামনে ‘রফরফ’ নামক বাহন আসলে তিনি তাতে আরোহন করে এক অদ্ভুত রহস্যলোকের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সাহায্য লাভের আশায় গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেন। সকল জ্ঞান, চিন্তা, সময় ও গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন স্তব্ধ হয়ে রইলো। রাসূল (সা.) এগিয়ে গেলেন সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার দিদারের প্রত্যাশায় অসীমের পথে।

১২. আল্লাহ তা’য়ালা দিদার লাভ: অবশেষে রাসূল (সা.) মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। নূরের পর্দা টেনে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে আত্মরূপ দর্শন করালেন। আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর মধ্যে অনেক কথা হলো। তখন রাসূল (সা.) সৃষ্টি লীলার রহস্য সম্যকরূপে উপলব্ধি করলেন এবং সৃষ্টিকে তিনি আক্ষরিক অর্থে সত্য করে চিনলেন।

১৩. অতিপ্রাকৃত জগত পরিদর্শন: এ সফরে রাসূল (সা.) আসমানে জান্নাত, জাহান্নম ও আখেরাতের বহুনিদর্শন প্রত্যক্ষ করলেন। জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির দৃশ্য তিনি অবলোকন করলেন। বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত সফরে রাসূল (সা.) যে অলৌকিক বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন, তা সাধারণ মানুষের জ্ঞান ও কল্পনা শক্তির বাইরে। মানুষ তাঁর পার্থিব ও বাহ্যিক জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে ঐসব রহস্য উপলব্ধি ও উন্মোচন করতে সক্ষম নয়। আল্লাহ তা’য়ালা এ অলৌকিক জগত প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য দান করে রাসূল (সা.) কে একান্তভাবে সম্মানিত করলেন।

১৪. প্রত্যাবর্তন: মিরাজের সফরে রাসূল (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উম্মতদের জন্য নেয়ামত স্বরূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রাপ্ত হন। রাসূল (সা.) সাফল্যময় এ সফর শেষ করে জীবরাইল (আ.) এর নেতৃত্বে বুরাকে চড়ে পুনরায় পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেন। মক্কা নগরীতে তাঁর নিজ ঘরে এসে দেখলেন জগত যেমন চলছিল, তেমনই চলছে। হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মিরাজে গমনের পূর্বে রাসূল (সা.) অযু করছিলেন। ফিরে এসে দেখলেন তখনও সে অযুর পানি গড়াচ্ছে।


সত্যিই মিরাজ ছিল রাসূল (সা.) এর জীবনের এক বিস্ময়কর ঘটনা। এ সফরে রাসূল (সা.) সৃষ্টির রহস্য অবলোকন করে তাঁর উম্মতের সার্বিক জীবন প্রণালী সম্পর্কে অবহিত হন। এ সফরের মাধ্যমে রাসূল (সা.) বিশ্ব জগতের সৃষ্টি লীলা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url