মহানবি (সা.) এর মাক্কী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

 

মহানবি (সা.) এর মাক্কী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

মহানবি (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে দীর্ঘ ১৩ বছর মক্কায় ইসলাম প্রচার করেন। এ সময় স্বীয় গোত্রের এবং মক্কার অধিপতিদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হন। তায়েফে গিয়ে নির্মমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। দু’বার সাহাবিদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার পরামর্শ দেন।

মহানবি (সা.) এর মক্কী জীবন:

১. জন্মলাভ: ঐতিহাসিক তাবারি, ইবনে খালদুন, ইবনে হিশাম, আমির আলীসহ অধিকাংশের মতে, নবিকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট, রবিউল মাসের ১২ তারিখ রোজ সোমবার ঝিরঝির সমীরণের দোলালাগা প্রভাতে মা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

২. বংশ পরিচিতি: হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ইবরাহীম (আ.) এর পুত্র ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর। মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশোদ্ভুত হাশেমী শাখায় মহানবি (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আর মাতার নাম আমিনা বিনতে ওয়াহাব।

৩. নামকরণ: ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, আমিনার গর্ভে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করলেন, পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখলেন ‘মুহাম্মদ’ এবং মা আমিনা শিশুর নাম রাখলেন ‘আহমদ। এ দুটি নামই পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে।

৪. পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত: মহানবি (সা.) এর পিতা আব্দুল্লাহ তাঁর জন্মের দু’মাস পূর্বে সিরিয়া থেকে বাণিজ্য শেষে দেশে ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে পিতৃমমতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ বঞ্চিত হন।

৫. ধাত্রীর পরিচর্যা: ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, জন্মের দু’সপ্তাহ পর নবজাত শিশু মুহাম্মদ (সা.) এর লালন-পালনের ভার বনি সা’দ গোত্রর ধাত্রী বিবি হালিমার ওপর দেওয়া হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি হালিমার গৃহেই অবস্থান করেন।

৬. একটি স্তন্য পান: ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক পি.কে.হিট্টি বলেন, মহানবি (সা.) হালিমার ডান পাশের স্তন্যটিই শুধু পান করতেন। বাম পামের স্তন্যটি হালিমার সন্তানের হক হিসেবে রেখে দিতেন।

৭. শিশুকালের বৈশিষ্ট্য: শিশু মুহাম্মদের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রশংসনীয়। শৈশবেই তাঁর মাঝে কোমল স্বভাব, মাধুর্যপূর্ণ কথাবার্তা, ধীরগতির চাল-চলন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রাবস্থায় থাকা ইত্যাদি বিস্ময়কর গুণের সমাবেশ ঘটেছিল।

৮. বক্ষ বিদীর্ণ ও বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শেখা: বিবি হালিমার তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় দু’জন ফেরেশতা মহানবি (সা.) এর বক্ষ বিদীর্ণ করেন। পর্যায়ক্রমে এ ঘটনা চারবার ঘটে। ঐতিহাসিক খোদা বক্স বলেণ, “শুধু বক্ষ বিদীর্ণ নয় এ সময় তিনি উৎকৃষ্ট আরবি ভাষায় কথা বলতেও অভ্যস্ত ন।”

৯. আমিনার গৃহে প্রত্যাবর্তন: ধাত্রী হালিমার গৃহ উজ্জ্বল করে মহানবি (সা.) পাঁচ বছর বয়সে মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন; কিন্তু ছয় বছর বয়সে মা আমিনাও পরপারে চলে গেলেন।

১০. আব্দুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে: ইব্রাহিম বলেন, মাতা-পিতা হারিয়ে মহানবি দাদা আব্দুল মুত্তালিবের কাছে লালিত-পালিত হতে থাকেন; কিন্তু ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মুত্তালিবও ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

১১. আবু তালিবের স্নেহাধীনে: দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব মুহাম্মদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর টানাটানির সংসার ছিল বিধায় কিশোর মুহাম্মদ (সা.) কে অবিলম্বে জীবিকা অর্জনে নেমে পড়তে হয়। এ সময় পাহাড়ের উপত্যকায় মুক্ত আকাশের নিচে মেষ চরাতেন।

১২. সিরিয়া গমন: ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, ৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ১২ বছর বয়সে প্রিয় নবি (সা.) চাচা আবু তালিবের সাথে বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সিরিয়া গমন করেন।

১৩. পাদ্রি বুহাইরার ভবিষ্যৎদ্বাণী: সিরিয়ার বসরা নগরে বুহাইরা নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রি মহানবিকে দেখে নবি হিসেবে শনাক্ত করেন এবং আবু তালিবকে তাঁর প্রতি লক্ষ রাখতে উপদেশ দেন।

১৪. ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভ: বালক মুহাম্মদ (সা.) এর সততা ও আমানতদারির প্রশংসনীয় চরিত্রের জন্য আরববাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে ‘আল-আমিন’ তথা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করে।

১৫. হারবুল ফেজারে অংশগ্রহণ: মুহাম্মদ (সা.) এর পনেরো বছর বয়সে মক্কায় সংঘটিত  কুরাইশ ও হাওয়াযেন গোত্রদ্বয়ের মধ্যকার ফেজার যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৬. হিলফুল ফুযুল গঠন: নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকেই মুহাম্মদ (সা.) সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। এ ধারাবাহিকতায় আর্তপীড়িত, ব্যথিত অত্যাচারিতকে রক্ষা ও আরবে শান্তি স্থাপন করতে কতিপয় শান্তিপ্রিয় যুবককে নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে একটি শান্তি সংঘ গড়ে তোলেন। ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি’ ছিল এ সংঘের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

১৭. বিবাহ: ২৫ বছর বয়সে মহানবি (সা.) তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য বিধবা মহিলা বিবি খাদিজা (রা.) কে বিয়ে করেন। ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল খুবিই মধুর।

১৮. হাজরে আসওয়াদ স্থাপন: কা’বা শরীফের সংস্কার উপলক্ষ্যে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মহানবি (সা.) কে সালিশ মানা হয়। তিনি সব গোত্র প্রধানের সমন্বয়ে এ বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান দেন।

১৯. চারিত্রিক মাধুর্য: বাল্যাবস্থা থেকেই মহানবি (সা.) চিন্তামগ্ন ও আধ্যাত্মিকতায় বিভোর থাকতেন। নিপীড়িত অত্যাচারিতদের প্রতি তিনি সর্বদাই ছিলেন সংবেদনশীল।

২০. নবুওয়াত লাভ ও দাওয়াত: ৪০ বছর ১১ দিন বয়সে মুহাম্মদ (সা.) হেরা পর্বত গুহায় নবুওয়াত লাভ করেন। নবুওয়াত লাভের পর প্রথম ৩ বছর গোপনে দাওয়াতি কাজ করেন। এতে মক্কার চল্লিশজন ইসলাম গ্রহণ করেন।

২১. কুরাইশদের নির্যাতন: ইসলামের শাশ্বত আহ্বানে সমগ্র আরবে সাড়া পড়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে বিদ্বেষপরায়ণ কায়েমি স্বার্থপর কুরাইশ নেতারা মহানবি (সা.) এর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর এমনকি মুহাম্মদ (সা.) এর ওপরও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। কুরাইশ নেতারা শিয়াবে আবু তালিবে মুহাম্মদ (সা.) তার পরিবার, গোত্রের লোকজন ও অনুসারীদের বন্দি করে রাখে।

২২. তায়েফ গমন: কুরাইশ নেতাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নবুওয়াতের দশম সালে মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ গমন করেন। তায়েফের কাফেররা বর্বরতম নির্যাতনে রক্তাক্ত করে মুহাম্মদ (সা.) কে সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করে।

২৩. মিরাজে গমন: নবুওয়াতের দশম বর্ষে ২৭ রজব সোমবার আল্লাহর বিশেষ আমন্ত্রণে মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে গমন করেন। বিস্তারিত...

২৪. মদিনায় হিজরত: কাফেরদের চরম বিরোধিতা আর তীব্র নির্যাতনের ফলে মুসলমানরা প্রথম হাবশায় হিজরত করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে আল্লাহ তা’য়ালার ওহি প্রাপ্ত হয়ে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই  মহানবি (সা.) মদিনায় হিজরত করেন।

মহানবি (সা.) যেমন পৃথিবীর বুককে আলোকিত করেছিলেন, তেমনি মুসলিম তথা সমগ্র মানবসমাজের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করে নতুন সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক এবং উন্নততর ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করে যান। আর মক্কার দীর্ঘ ১৩ বছর ইসলাম প্রচারকালে এ সমস্ত পদক্ষেপের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। উক্ত সত্য বাস্তবায়ন করতে কুরাইশদের চরম অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাঁর অনেক অনুসারী অত্যাচারে নিহত হয়েছে। এতো কিছুর পরেও আল্লাহ তা’য়ালার দ্বীন প্রচারে তিনি ক্ষণিকের জন্যও পিছপা হননি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url